Tears of Victim

সংখ্যালঘু নির্যাতনে আওয়ামী লীগ

1,790

সংখ্যালঘু নির্যাতনের সকল ঘটনার সাথে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জড়িত। ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে কয়েকবার সংখ্যালঘুদের ওপর আওয়ামী লীগ নির্যাতন করে তা জামায়াত-শিবিরের নামে অপপ্রচারের চেষ্টা চালায়। কিন্তু প্রত্যেকটি ঘটনা’র পর স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায় এর সবগুলোর সাথে আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ, যুবলীগের কর্মীরা জড়িত। মূলত এসব ঘটনায় বিরোধী মতের রাজনীতিকে দোষারোপ করে নিজস্ব মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারণা করে আন্তর্জাতিক মহলে ফায়দা লুটতেই আওয়ামী লীগ এসব ঘটিয়ে থাকে বলে প্রমাণিত হয়েছে বারবার।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হাতে দেশজুড়ে হামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ। সংখ্যালঘুদের মধ্যে হতে দুর্বলদের জায়গা-জমি, ঘরবাড়ি, মন্দির, শ্মশান, সমাধিক্ষেত্র থেকে শুরু করে ভিটেমাটি, সহায়-সম্বল দখল ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগের কর্মীদের অনেকের বিরুদ্ধে। ‘ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত’ করার প্রতিশ্র“তি দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেও ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হাতেই বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন গত পাঁচ বছরে। মারধর, শ্লীলতাহানির পাশাপাশি আগুনে পুড়িয়ে, কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকটি। হামলা ও নির্যাতনের তালিকায় কয়েকটি স্থানে পুলিশের নামও রয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাবে, এ সরকারের প্রথম বছর ২০০৯ সালে দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনে ৫৬৯ জন এবং ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর ৬১ জন আহত হয়েছে। কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের অনুসন্ধানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আওয়ামী লীগ কর্তৃক ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের ২০০৯ ও ২০১০ সালের কয়েকটি চিত্র তুলে ধরা হলো:


২০১০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পিরোজপুরের নাজিরপুরে রুহিতলাবুনিয়া গ্রামে মন্দিরের জমি দখল করার জন্য আওয়ামী লীগ নেতা আলাউদ্দিন মাঝি ও অপর আওয়ামী লীগ নেতা মনোরঞ্জন গোলদার গ্র“পের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হয় ২৫ জন। মনোরঞ্জনের দাবি, ৪০ বছর ধরে শ্রী শ্রী গোবিন্দ মন্দিরের কমিটির নিয়ন্ত্রিত জমিটি দখলের জন্য আলাউদ্দিন মাঝির লোকজন হামলা করে প্রতিমাসহ মন্দিরের আসবাবপত্র ভাঙচুর করে।

২০১০ সালের ১১ আগস্ট রাজধানীর সূত্রাপুর ৭৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা হাজী ইসলাম ও সূত্রাপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেনের নেতৃত্বে শতাধিক দলীয় লোক দক্ষিণ মৈশুণ্ডির ২২২, লালমোহন সাহা স্ট্রিটে শ্রী শ্রী রাধাশান্ত ঠাকুরাণী লক্ষ্মী জনার্ধনচক্র বিওবিগৃহ মন্দিরে হামলা করে। তাদের হামলায় ৩৫টি পরিবার অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
২০১০ সালের ১২ জুলাই নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার নাকইলে ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর এক পল্লীতে আওয়ামী লীগ কর্মী শরীফুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল ভূমিদস্যু জমি দখলের জন্য হামলা চালায়। ২০১০ সালের ২৫ মে রাজশাহীর চারঘাটে জমির সীমানা নিয়ে বিরোধে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী আজহার উদ্দিন তার দলবল নিয়ে অনিলচন্দ্র মণ্ডলের বাড়িতে হামলা চালায়। দুর্বৃত্তরা অনিলচন্দ্র, তার স্ত্রী বাসন্তী রানী, ছেলে শ্যামলচন্দ্র মণ্ডল, তার ভাই অভিচরণ মণ্ডল, অভিচরণ মণ্ডলের স্ত্রী শান্তা রানীকে কুপিয়ে জখম করে।

২০১০ সালের ১৭ মে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার ব্রাহ্মণবাজারের সিঙ্গারপুর পানপুঞ্জিতে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সমাধি দখল করে ক্রুস গুঁড়িয়ে দেয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মতিন ও তার সহযোগীরা।২০১০ সালের ১৪ মে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের উজয়মারিতে ২২টি সংখ্যালঘু পরিবারের জমি দখল করে নেন আওয়ামী লীগের এক কর্মী। ওই জমিতে ইটভাটা তৈরির কাজ শুরু করেন তিনি। দখলে বাধা দেয়ায় রমেশ মণ্ডলসহ তিনজন আহত হন দখলদার এ আওয়ামী কর্মীর হাতে।
২০১০ সালের ২০ এপ্রিল ঢাকার কেরানীগঞ্জের আতাশুর গ্রামে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মী পরিচয় দিয়ে সালাউদ্দিন, সালাম, মোস্তফা, সাজু, সাজ্জাদ, পিন্টুর নেতৃত্বে একটি দল জমি দখল করতে গেলে বাধা দেয়ায় অজিত করাতি ওরফে ক্ষিরমোহনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় আহত হয়েছিল ১০ জন হিন্দু।

২০১০ সালের ৫ মার্চ নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামে হিন্দু তিন পরিবারের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীরা। কয়েক বছর আগে আওয়ামী লীগ কর্মী আবদুর রাজ্জাকের ছেলে রেজাউলসহ কয়েকজন স্থানীয় হিন্দু নবকুমারের ছেলে প্রদীপকুমারকে রামদা দিয়ে কোপায়। বাবা ও ছেলেকে টেনেহিঁচড়ে আবদুর রাজ্জাকের বাড়িসংলগ্ন একটি শিমুলগাছে বেঁধে মারধর করা হয়। পরে গলায় রামদা ধরে তাদের কাছ থেকে মামলা তুলে নিতে কাগজে সইও নেয়া হয়। পরে তাদের বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার আমড়াগাছিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাখালীতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। আমড়াগাছিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মুজিবর রহমান ছায়েদের লোকজন ১ এপ্রিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী শঙ্করের বাড়িতে হামলা করে ভাই সুভাষকে জখম করে। ২০১০ সালের ৫ এপ্রিল সীতাকুণ্ডে সংখ্যালঘুদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ, নির্যাতন ও হামলা-মামলার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করায় সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রতিরোধ ও কল্যাণ কমিটির সভাপতি আমিরাবাদ মায়াকুঞ্জের বাসিন্দা অমরেন্দ্র মল্লিককে পিটিয়ে এলাকাছাড়া করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীরা। অমরেন্দ্রের বাড়িতে হামলা করে ও তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেকে উলঙ্গ করে বেধড়ক মারধর করা হয়। পরে তাদের প্রকাশ্যে পেটাতে পেটাতে পৌর ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। ভবনের একটি কক্ষে আটকে রেখে পৌর মেয়র শফির নেতৃত্বে বাবা ও ছেলেকে বেধড়ক মারধর করা হয় বলে অভিযোগ করেন অমরেন্দ্র। ওই সময় অমরেন্দ্রের বিবাহিত মেয়ে বাবা ও ভাইয়ের খোঁজে কাঁদতে কাঁদতে পৌর ভবনে এলে তাকে পাশের একটি কক্ষে নিয়ে লাঞ্ছিত করা হয়। একই দিন বাবা-ছেলের নামে চুরি ও মারধরের মামলা দিয়ে আদালতে চালান দেয়া হয়। এসব ঘটনার পর সীতাকুণ্ডের স্থানীয় এমপি আবুল কাশেম মাস্টারের ভাগ্নের হাতে শতাধিক সংখ্যালঘু জেলে পরিবার অবরুদ্ধ হওয়ার প্রতিকার চাইতে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনের ব্যানারে অমরেন্দ্র লেখেন, চট্টগ্রামে নৌকার কাণ্ডারি ও মাঝিমাল্লা কর্তৃক হামলা-মামলা, নির্যাতন ও বাপ-দাদার ভিটেভূমি, সহায়-সম্পত্তি জবরদখলের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন।’


২০০৯ সালের ২২ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়ার তাজপুর গ্রামে দেবোত্তর সম্পত্তি নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে বাড়িতে ও খড়ের পালায় দুর্বৃত্তরা অগ্নিসংযোগ করে। এতে রাজবিহারী ঘোষ নামের এক বৃদ্ধ দগ্ধ হয়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। ঐক্য পরিষদের নেতা এডভোকেট রানা দাসগুপ্ত বলেন, সরেজমিন অনুসন্ধানে উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ আসে। ২০০৯ সালের ২০ ডিসেম্বর সাতক্ষীরার দেবহাটার ঢেবুখালিতে ৩০০ বিঘার একটি ঘের দখল করে নেয় আওয়ামী লীগ নেতাদের একটি বাহিনী।

২০০৯ সালের ১১ জুলাই ঢাকার দোহারের নারিশা পূর্বচর গ্রামে সংখ্যালঘু নৃপেন মালাকারের জমিতে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে তা দখল করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীরা। ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কর্মী পরিচয় দেয়া একদল সন্ত্রাসী বন্দুক উঁচিয়ে কাফরুল থানার পুলিশের সামনেই ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী রীতা গমেজের বাড়ির একাংশ দখল করে নেয়। রীতার পরিবার থানায় অভিযোগ করতে গেলে তা নেয়া হয়নি।

২০০৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার বালাশুর গ্রামে নাগমন্দিরে দুষ্কৃতকারীদের হামলায় মন্দিরের সেবায়েতসহ ৮ জন আহত হন। শ্রীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হানিফ বেপারির নেতৃত্বে দুষ্কৃতকারীরা এ হামলা চালায়।

২০০৯ সালের ২২ আগস্ট রাজধানীর সূত্রাপুরের ৯৫, ঋষিকেশ দাস লেনে আওয়ামী লীগ আশ্রিত সন্ত্রাসীরা এক হিন্দু পরিবারের বাড়ি দখল করতে গিয়ে ওই পরিবারের ৯ জনকে মারধর, লুটপাট ও পরে তাদের অপহরণ করে। এর আগে তাদের বাড়িটি বিক্রি করার জন্য ভয়ভীতি ও হুমকি দেয়া হয়েছিল। ২০০৯ সালের ১২ জুন নওগাঁ জেলার পোরশা উপজেলার ছাওর ইউনিয়নে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর মানুষের ওপর দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়ে তাদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং লুটপাট চালায়। হামলায় ২৫ জন আহত হয়। নূর হোসেন নামে এক আওয়ামী লীগ নেতা জাল দলিল করে জমি দখল করার উদ্দেশ্যে লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ করেন ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর নেতা নরেন্দ্রনাথ মুর্মু।

২০০৯ সালের মে মাসে সাতক্ষীরার আবাদের হাটের ঘোষাল পরিবারের ৩৮ বিঘা জমি দখল করে নেয় স্থানীয় যুবলীগের এক ক্যাডার ও তার সহযোগীরা। পরে গ্রামের পাঁচ শতাধিক লোক লাঠিসোটা নিয়ে ওই জমি থেকে দখলবাজদের হটিয়ে দেয়। সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে গোবিন্দকাটি গ্রামের আওয়ামী লীগের এক নেতা দক্ষিণ শ্রীপুর ইউপির সাবেক মেম্বার স্মৃতি সরকারকে তার জমি থেকে হটিয়ে দিয়েছেন। ২০০৯ সালের ৩১ মার্চ সাতক্ষীরার দেবহাটার কালাবাড়িয়ায় মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ ঘোষের মালিকানাধীন ৩০০ বিঘার ঘের দখল করে নেয় আওয়ামী লীগ কর্মীরা। ১৯৭৯ সালে সুভাষ ঘোষের বাবা ওই জমি সরকারের কাছ থেকে নিলামে কেনেন। দখলে বাধা দিলে তার স্বজনদের পিটিয়ে আহত করা হয়।

২০০৯ সালের ১৫ মার্চ সাতক্ষীরা সদর উপজেলার যুগিপোতা গ্রামের রবিন মণ্ডলের ১২ বিঘা জমির চিংড়িঘের দখল করে নেয় আওয়ামী লীগ আশ্রিত তিন সন্ত্রাসী। এতে বাধা দেয়ায় রবিন মণ্ডলকে তারা মারধর করে। পরে জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতার সহযোগিতায় এ ঘটনায় উল্টো রবিন মণ্ডলের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরা সদর থানায় একটি মামলা করা হয়। ২০০৯ সালের ২৭ মার্চ ফেনী সদর উপজেলার কাজীরবাগ বাজারে যুবলীগ ক্যাডার সুমনের নেতৃত্বে বেলাল হোসেন আপেল, মহিউদ্দিন নূরন নবী, অনিক বিশ্বাস, দেলু, মো: ইসমাইল, নিজাম উদ্দিন, মো. আজাদ ও আবদুর রহিম সশস্ত্র হামলা চালিয়ে সংখ্যালঘু হীরা বণিকের ঘরবাড়ি ভাঙচুর এবং ৫ লাখ টাকার মালামাল লুট করে।

২০০৯ সালের ২৮ মার্চ জয়পুরহাট সদর উপজেলার ভাদসা ইউনিয়নের পণ্ডিতপুরের হিন্দু ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত সরকারপাড়ার বিমলচন্দ্র সরকারের বাড়িতে সরকারি দল আশ্রিত সন্ত্রাসীরা অগ্নিসংযোগ করলে গোয়ালঘরে থাকা চারটি গরু পুড়ে মারা যায় এবং আরও তিনটি গরু অগ্নিদগ্ধ হয়। ২০০৯ সালের ৩০ মার্চ রাজধানীর সূত্রাপুরে ৫০ বছরের পুরনো একটি মন্দির ভেঙে ফেলে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা। ৩২ কাঠা সম্পত্তি রয়েছে এই মন্দিরের। ওই সম্পত্তিতে হিন্দু-মুসলমান মিলে মোট ৬৮টি পরিবার বসবাস করে। আওয়ামী লীগ সমর্থক সালেহ এবং তার দুই ছেলে দিপু ও আসাদ ১৩টি হিন্দু পরিবারকে উচ্ছেদ করে মন্দিরের সম্পত্তি দখল করে নেয়। ওই সময় শিব, কালী ও সরস্বতীর প্রতিমা ভেঙে ফেলা হয়।

২০১০ সালের ২০ এপ্রিল কেরানীগঞ্জে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সম্পত্তি দখল করতে গিয়ে অজিত করাতি ওরফে ক্ষীরমোহনকে (৫৫) পিটিয়ে হত্যা করে। এ সময় চারটি বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাটও করা হয়। অজিত করাতিকে পিটিয়ে হত্যার ভিডিও ফুটেজ ক্যামেরায় ধারণ করায় পুলিশ সাংবাদিকদের লাঞ্ছিতও করে। ২০০৯ সালের ২২ ডিসেম্বর রাতে সিংড়ার তাজপুর গ্রামে দেবোত্তর সম্পত্তি নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে বাড়িতে ও খড়ের পালায় দুর্বৃত্তরা অগ্নিসংযোগ করে। এতে রাজবিহারী ঘোষ নামে একজন বৃদ্ধ দগ্ধ হন। দুই দিন পর তিনি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। ঐক্য পরিষদের নেতা অ্যাডভোকেট রানা দাসগুপ্ত অভিযোগ করেছেন, আমি ওই গ্রামে তদন্ত করতে যাই। পরে দেখি ৯০ একর জমি নিয়েই এ বিরোধের সূত্রপাত। পরিস্থিতি অনুযায়ী উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতাদেরই স্থানীয় সংখ্যালঘুরা দায়ী করেছেন।

২০০৯ সালের ২৫ জুলাই নরসিংদীর পলাশের চরসিন্দুর গ্রামে শ্মশানের জায়গা দখলকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘুদের চারটি বাড়িঘর ও মূর্তি ভাঙচুর এবং তাদের বাড়িতে লুটপাট করা হয়। ২২ ফেব্র“য়ারি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার বড়মাছুয়া ইউনিয়নের খেজুরবাড়িয়া গ্রামের সিকদার বাড়িসহ চার সংখ্যালঘু পরিবারের পানের বরজ ও খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার কয়েকদিনের মাথায় বিদেশ ফেরত এক ছাত্রলীগ নেতা পুরনো সাতক্ষীরায় দেবেন্দ্র চ্যাটার্জির মালিকানাধীন জমি দখল করে নেয়। এছাড়াও বড় বড় ঘটনার মধ্যে রামুর বৌদ্ধ মন্দির ভাংচুর ঘটনায় আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততাই প্রমাণিত হয়েছে।

উত্তম কুমার বড়ুয়া নামের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এক যুবকের পবিত্র কুরআন শরিফ অবমাননার প্রতিবাদে কক্সবাজার এলাকায় উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এ উত্তেজনাকে পুঁজি করে গত ২৯ সেপ্টেম্বর শাসকদল স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার নেতৃত্বে মিছিল বের হয়। এ মিছিল পরিকল্পিতভাবে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বসতিতে হামলা চালায়। তাদের হামলায় রামু উপজেলায় ১১টি বৌদ্ধমন্দির ও অর্ধশত ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে। ভাংচুর করা হয়েছে আরও দুটি বৌদ্ধমন্দির এবং শতাধিক বসতঘর।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, মিছিলকারীরা, পেট্রোল, গান পাউডার নিয়ে যখন বৌদ্ধপল্লীর দিকে রওনা করে তখন একাধিক বৌদ্ধ ধর্মগুরু থানায় ফোন করে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন, কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণে পুলিশ আসেনি। তারা বলেন, পুলিশ সরকারবিরোধী আন্দোলন দমাতে এত তৎপরতা দেখাতে পারে, তাদের লাঠিচার্জ টিয়ারশেল আর শর্টগানের গুলিতে বিরোধীদলের নেতাকর্মীরা রাস্তায় দাঁড়াতে পারে না, কিন্তু বৌদ্ধদের বাঁচাতে কেন একটি টিয়ারশেল, এক রাউন্ড শর্টগানের গুলিও খরচ হলো না? সরকারের গোয়েন্দা বিভাগই বা কী করলো?

যদিও রামুর ঘটনায় সরকারের আজ্ঞাবহ মিডিয়াগুলি জামায়াত শিবিরকে দায়ী করতে উঠে পড়ে লেগেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্য বের হয়ে আসে। ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলার ঘটনার পেছনেও বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই দায়ী, প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র উল্লেখ করে বিভিন্ন জাতীয় পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন এ কথাই বলছে। যেমন ‘ঘটনার রাতে (২৯ সেপ্টেম্বর) ওসিকে ফোন করে দ্রুত আসতে বললে তিনি আসেন। তিনি এসে দেখেন, রামু বাজারের মোড়ে ফারুকের দোকানে অনেকে জড়ো হয়ে ফেসবুকের ছবি দেখছেন। তিনি দোকানে ঢুকে দেখতে পান, উত্তম কুমার বড়ুয়া নামের এক তরুণের ফেসবুক থেকে পবিত্র কুরআন শরিফ অবমাননার একটি ছবি তার ২৬ জন বন্ধুর কাছে পাঠানো হয়েছে। তিনি কম্পিউটারটি জব্দ করে থানায় আনেন। এরপর উত্তমকে গ্রেফতার করতে তার বাসায় যান। সেখানে গিয়ে দেখেন, উত্তমের মা ও তার বোন ছাড়া বাসায় কেউ নেই। তিনি তাদের আটক করে থানায় আনেন। রামু মোড়ে এসে দেখতে পান, সেখানে সমাবেশ হচ্ছে। এতে রামু নাগরিক উন্নয়ন কমিটির সভাপতি ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা নূরুল ইসলাম ওরফে সেলিম ও মৎস্যজীবী লীগের নেতা আনসারুল হকসহ কয়েকজন বক্তব্য দেন। ওসিও বক্তব্য দেন। এক ঘণ্টা পর সমাবেশটি শেষ হয়। এলাকায় তখন উত্তেজনা বিরাজ করছিল। কিন্তু ওসি একেবারে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। কিছুক্ষণ পর ওসি শ্রীকুলের লালচিং মন্দিরে পাহারার জন্য যেতে বললে তিনি তিন সহকর্মী নিয়ে সেখানে যান। ওই মন্দিরে হামলার চেষ্টা করা হলে তিনি ওসির কাছে অতিরিক্ত লোক চান। বারবার ফোন করলেও ওসি সাড়া দেননি। একপর্যায়ে তিনি ওসির ফোন বন্ধ পান। ফলে তিনজনকে নিয়ে মন্দিরের সামনে তিনি অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁদের সামনেই মন্দিরটি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।’ (সূত্র : প্রথম আলো ৭ অক্টোবর ২০১২)। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ক্ষমতাসীন দলের ইঙ্গিতেই নিষ্ক্রিয় ছিলেন এমনটাই মনে করছেন, পর্যবেক্ষকমহল।

সদ্য ঘটে যাওয়া পাবনার সাঁথিয়ায় হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনার ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগের ইন্ধন ও সক্রিয় উপস্থিতিই নিশ্চিত হয়েছে।

গত ২ নভেম্বর ২০১৩ শনিবার ফেসবুকে পবিত্র কুরআন শরীফ ও মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা) সম্পর্কে কটূক্তির খবর ছড়িয়ে পড়লে পাবনার সাঁথিয়ায় বনগ্রামে হিন্দুদের ১২/১৪ টি বাড়ি ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। শনিবার সকাল ১১ টার দিকে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের আহবায়ক জাকির হোসেন, ছাত্রলীগ নেতা কাওসার হাবিব সুইট, মতির ছেলে খোকনসহ ১০/১২ জন যুবক প্রথমে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার একটি প্রিন্ট কপি বের করে বনগ্রাম বাজারে ছড়িয়ে দেয়। পরে বাবলু সাহার মুদিখানার দোকানে গিয়ে ফেসবুকে উক্ত স্ট্যাটাসদাতা হিসাবে অভিযুক্ত তার ছেলে রাজিবের খোঁজ করে। পরে তাকে না পেয়ে দোকানে ভাংচুর করে। এক পর্যায়ে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে বনগ্রামে হাটের দিন হওয়ায় হাজার হাজার লোকজন একত্রিত হয়ে সাহাপাড়ায় হামলা চালিয়ে বাড়ি-ঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করে।


হামলার কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাজিব সাহার পিতা বাবলু সাহা সাংবাদিকদের বলেন, গত তিন মাস আগে তার মেয়ের বিয়ের সময় ২ লাখ টাকা চাঁদা চেয়েছিল। তিনি সেই টাকা প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করলে সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন সময় ফোনে হুমকি ধমকি দিচ্ছিল। তারা ক্ষতি করার জন্য এই ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে বলে তিনি ধারণা করছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু ঘটনার পরে এলাকা পরিদর্শনে গেলে তার পাশে পাশে থাকতে দেখা যায় ঐ হামলায় অংশ নেয়া যুবক মিঠু, রুবেল ও অনিককে। তারা মন্ত্রীর সাথে সাথে থেকে শ্লোগান দিতে থাকে। মন্ত্রীর সাথে তাদের ছবি ছাপা হলে প্রত্যক্ষদর্শীরা তাদেরকে সনাক্ত করে। অথচ পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার পর্যন্ত করেনি। এ ঘটনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় হামলাকারী এবং হামলায় ইন্ধনদাতাদের দলীয় পরিচয়।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.