দিল্লিকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ এবং একতরফা বন্ধুত্ব গড়তে গিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ ভারতের পদতলে ঠেলে দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মধ্যে ফেলে ভারতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যুক্ত করা হয়েছে বাংলাদেশকে। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময়ে ৫০ দফার যৌথ ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরের মাধ্যমে মূলত বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে ভারতের কাছে বিকিয়ে দেয়া হয়েছে। ঐ ঘোষণাপত্রে দেয়া প্রতিশ্রুতির সব একে একে বাস্তবায়ন করে চলেছে বাংলাদেশের আওয়ামী সরকার। অন্যদিকে ঐ ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের জন্য দেয়া আশ্বাস যে মিথ্যা আশ্বাস ছিল, তা এখন প্রমাণিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময়ে সীমান্তে সন্ত্রাস দমন এবং মাদক চোরাচালান রোধে ভারতের প্রস্তাব অনুযায়ী দু’দেশের মধ্যে ৩টি চুক্তি সই হয়। আসলে ওই চুক্তির মোড়কে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৭ রাজ্যে বিদ্রোহ দমনে সম্পৃক্ত হওয়ার ফলে বাংলাদেশ বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
ট্রানজিট
বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে ভারতকে ফ্রি ট্রানজিট দেয়ার যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রানজিটের নামে বর্তমান সরকার আসলে ভারতকে করিডোর দিচ্ছে। এরই মধ্যে ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্রি নৌ-ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে সরকার। এমনকি কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই ভারত এই ট্রানজিট সুবিধা পাচ্ছে।
ট্রানজিটের ব্যাপারে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ সরকারকেই সব সময় বেশি আগ্রহী মনে হয়েছে। ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার রঞ্জিত মিত্র বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডে ভারত সরকার বাংলাদেশকে ট্রানজিট ফি দিতে রাজি আছে। এর মাত্র কয়েকদিন পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন যে ভারতের কাছে ট্রানজিট ফি চাওয়া হবে অসম্মানজনক। ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী ঘোষণা দিলেন, ভারতকে ট্রানজিট দিতে কোনো চুক্তি সইয়ের প্রয়োজন নেই। ২০১১ সালের মার্চ মাসে পরীক্ষামূলক ট্রানজিটের নামে কোনো ধরনের ফি ছাড়াই ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৮ হাজার টন ভারী যন্ত্রপাতি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পরিবহনের সুযোগ দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। ৯০টি কন্টেইনারে এসব ভারী যন্ত্রপাতি আশুগঞ্জ বন্দর হয়ে ত্রিপুরায় যায়। ওই একই প্রক্রিয়ায় ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে ৩৫০ টন পণ্য, ৯০০ টন টিন, ৬২১ টন লোহা এবং ৩০০ টন সিমেন্ট তৈরির কেমিক্যাল বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পরিবহন করে ভারত। ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে একই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ৩ হাজার ২২৫ টন কয়লা ও সিমেন্টের রাসায়নিক পণ্য যায় পূর্ব ভারতে। ট্রানজিটের উপযুক্ত অবকাঠামো না থাকার পরও ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার ফলে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের। ভারতীয় পণ্য বিশেষ করে ভারী যন্ত্রপাতি পরিবহনের ফলে বাংলাদেশের রাস্তাঘাট ভেঙে যাচ্ছে। ট্রানজিটের জন্য তিতাসসহ ১৮টি নদী ও খালে বাঁধ দিয়ে বন্ধ করার মতো পরিবেশ বিপর্যয়কর আত্মঘাতী কাজ করেছে সরকার। তিতাস নদীতে বাঁধ দেয়ার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের মুখে ভারতীয় পণ্য আর যাবে না বলে ঘোষণা দেয় সরকার। তবে অনেকটা গোপনে আবারও ভারতকে পণ্য পরিবহনের অনুমতি দেয় এ সরকার। মিথ্যা মানবিক কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ত্রিপুরায় ১০ হাজার টন খাদ্যশস্য পরিবহনের অনুমতি দেয়া হয়েছে ভারতকে। এছাড়া আরও ৩০ হাজার টন পণ্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে আসামে নেয়ার অনুমতিও পাচ্ছে ভারত। ভারতের জন্য ট্রানজিট সুবিধা আরও সহজতর করতে আশুগঞ্জ বন্দরের উন্নয়নের জন্য ২৪৫ কোটি টাকার প্রকল্পও চূড়ান্ত করেছে আওয়ামী লীগ সরকার।
সীমান্ত হত্যা
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বারবার সীমান্ত হত্যা বন্ধের ব্যাপারে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্র, অধিকারসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার হিসাব অনুযায়ী গত ৫ বছরে প্রায় ৫০০ নিরীহ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে বিএসএফ। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানের সীমান্ত রয়েছে। তবে একমাত্র বাংলাদেশ সীমান্তেই ভারত নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে জঘন্য এবং আলোচিত ঘটনা হলো সীমান্তে কিশোরী ফেলানী হত্যাকাণ্ড। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ১৫ বছরের কিশোরী ফেলানীকে বিএসএফ সদস্যরা গুলি করে মেরে কাঁটাতারের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে। ঐ জঘন্য ঘটনার বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এমনকি ভারতের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। অন্যদিকে ঐ নিষ্ঠুর বর্বরতার প্রতিবাদ না জানিয়ে বরং সীমান্ত হত্যাকে বৈধতা দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, সীমান্ত হত্যা দু’দেশের সম্পর্কের ওপর কোনো ধরনের প্রভাব ফেলবে না। এরপর দেশে এবং দেশের বাইরে শুরু হয় ব্যাপক প্রতিবাদ। ঐ প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখে ফেলানী হত্যার ৮ দিন পর একটি লোক দেখানো প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে ভারত শেষ পর্যন্ত বিচারের নামে একটি তামাশা করে। গত ১৩ আগস্ট ফেলানী হত্যার বিচার কাজ শুরু হয়। ৬ সেপ্টেম্বর মামলার রায়ে ফেলানীর হত্যাকারী বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়। দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হলো, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করেনি। ফেলানীর পক্ষে মামলাকারী দু’জন ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠক ঐ রায়ের পর বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার তাদের ভিসা দেয়নি। সীমান্তে নিহত বিচার বঞ্চিত অজস্র্র বাংলাদেশীর প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে ফেলানী।
টিপাইমুখ বাঁধ
২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফরের সময় বাংলাদেশের জন্য মরণ ফাঁদ হিসেবে চিহ্নিত তিন কোটি মানুষের জন্য হুমকি টিপাইমুখ পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পেরও সম্মতি দিয়ে আসেন। বোরাক নদের অববাহিকায় বাঁধ দিয়ে এই পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হবে। এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত থাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ঘোষণা দেন বাংলাদেশের ক্ষতি হয় টিপাইমুখ প্রকল্পে এমন কোন পদক্ষেপ নেয়া হবে না। পরে দু’দেশের পক্ষ থেকে একটি সমীক্ষার কথাও বলা হয়। যৌথ সমীক্ষার নামে যা করা হয়েছে, তা রীতিমত জালিয়াতি।
২০১২ সালে ২৬ থেকে ২৯ আগস্ট যৌথ নদী কমিশনের সদস্য মীর সাজ্জাদ হোসেনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল যৌথ সমীক্ষা কাজ সম্পন্ন করতে ভারত সফর করে। ওই প্রতিনিধিদল টিপাইমুখ এলাকা পরিদর্শন না করে দিল্লি ঘুরে ঢাকায় ফিরে আসে। অর্থাৎ বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলকে দিল্লির বাইরেই যেতে দেয়া হয়নি। টিপাইমুখ ও বোরাক অববাহিকা পরিদর্শন না করে যৌথ সমীক্ষার কাজ সম্পন্ন করার বিষয়টি রীতিমত হাস্যকর। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে ভারত সরকার টিপাইমুখ প্রকল্পটি হাতে নেয়। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সিলেট অঞ্চল মরুময়তার কবলে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন।
তিস্তা চুক্তি ও সীমান্ত প্রটোকল
পররাষ্ট্রবিষয়ক সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু তিস্তা চুক্তি ও সীমান্ত প্রটোকল নিয়ে ভারত এবং বাংলাদেশের উভয় সরকারই বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে রীতিমত প্রতারণা করেছে। গত পাঁচ বছর ধরেই একের পর এক মিথ্যাচার করা হয়েছে তিস্তা চুক্তি ও সীমান্ত প্রটোকল বাস্তবায়ন নিয়ে। তিস্তা চুক্তি সই ও সীমান্ত প্রটোকল বাস্তবায়ন হবে-এই প্রতিশ্র“তিতেই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের সব দাবিই একে একে পূরণ করেছে। সরকারের মেয়াদ শেষে এটা এখন নিশ্চিত যে, তিস্তা চুক্তি সই ও সীমান্ত প্রটোকল বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে দিল্লি সফর শেষে ঢাকায় ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ঘোষণা দেন, খুব শিগগিরই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ও সীমান্ত প্রটোকল বাস্তবায়ন হবে। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে দু’দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ঢাকায় আসার আগে দু’দেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে দুইদেশ একমত হয়েছে। তবে মনমোহন সিং ঢাকায় রওনা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে ভারতের পররাষ্ট্র দফতর থেকে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জানানো হয়, এ সফরে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর আপত্তির কারণেই তখন তিস্তা চুক্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
তিস্তা চুক্তির মতো একই ভাগ্য বরণ করেছে সীমান্ত প্রটোকল বাস্তবায়নের বিষয়টিও। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিব স্বাক্ষরিত সীমান্ত প্রটোকলটি ভারত এখনও সমর্থন করেনি। যদিও বাংলাদেশ তখনই এটি অনুসমর্থন করে। সীমান্ত প্রটোকল অনুসমর্থনের জন্য বিলটি ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন ইউপিএ সরকার সংসদেই তুলতে পারেনি। বিরোধী দল বিজেপির আপত্তির কারণেই এটি সম্ভব হচ্ছে না বলে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। অনেক চেষ্টার পরও এক্ষেত্রে কোন ফল হয়নি যেমন ফল হয়নি তিস্তার ব্যাপারে মমতা ব্যানার্জীর সহায়তা চেয়েও।
জনস্বার্থ ও পরিবেশ বিরোধী রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্বোধন
২০১৩ এর ৫ অক্টোবর উদ্বোধন করা হয়েছে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক মেগা প্রজেক্ট রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের। দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে প্রচারণা চালায় সরকার। কিন্তু পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বাস্তব চিত্রগুলি অগ্রাহ্য করেছে তারা। উৎপাদন শুরু হলে রামপালে প্রতিদিন প্রয়োজন হবে ১০ হাজার টন কয়লা। শুধু বিদ্যুৎ নয় সাথে উপহার হিসেবে কেন্দ্রটি অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদানের সাথে প্রতিদিন দেবে ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইড ও ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড। বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন কয়লা পুড়িয়ে সাড়ে ৭ লাখ টন ফাই-অ্যাশ পাওয়া যাবে। শুধু বাতাস নয়, মাটি-পানিও পাবে ২ লাখ টন বটম-অ্যাশ। এ বিপুল পরিমাণ অ্যাশ ছড়িয়ে পড়বে আশপাশের এলাকায়। পরিবেশ হবে দারুণভাবে বিপর্যস্ত। ইকো-সিস্টেম মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। প্রাণ-বৈচিত্র্য হবে বিপন্ন।
বিলীন হয়ে যাবে সুন্দরবন
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে ১৯৭৯ সালে একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল, যা থেকে বছরে ৩০ হাজার টন সালফার ডাই-অক্সাইড তৈরি হচ্ছে। ২০১০ সাল পর্যন্ত হিসাবে দেখা যায়, বিশেষত সালফার ডাই-অক্সাইডের ভয়াবহ প্রভাব কেন্দ্রটি থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত পৌঁছে সেখানকার পেকান, ওক প্রভৃতি গাছের বাগান মারা পড়েছে। উল্লেখ্য, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। উপর্যুক্ত হিসাবে রামপাল থেকে তৈরি হবে বছরে ৫১ হাজার ৮৩০ টন সালফার ডাই-অক্সাইড যা টেক্সাসের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির তুলনায় অনেক বেশি। টেক্সাসের অভিজ্ঞতা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যেই বিলীন হবে সুন্দরবন।
নদীর পানি হবে বিষাক্ত
জানা গেছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য প্রয়োজনীয় ঘণ্টাপ্রতি ৯ হাজার ১৫০ ঘনমিটার পানি সংগ্রহ করা হবে সুন্দরবনের প্রাণখ্যাত পশুর নদ থেকে। ব্যবহার ও পরিশোধন শেষে ৫ হাজার ১৫০ ঘনমিটার পানি পশুর নদকে ফেরত দেয়া হবে। সুতরাং পশুর নদের পানি প্রবাহে ঘাটতি হবে দিনে ৯৬ হাজার ঘনমিটার। পানি ফেরত কম দেওয়া হলেও বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ বাড়তি হিসেবে যোগ হবে সে পানিতে। এক্ষেত্রে পশুর নদের পানি বুড়িগঙ্গার বিষাক্ত পানির চেয়েও অনেক বেশি বিষাক্ত হবে। পশুর নদের মাছসহ অন্যান্য প্রাণী, সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের জীবনচক্রে পড়বে মারাত্মক প্রভাব। একে একে ধ্বংস হবে সব।
ভারতের লাভ আর বাংলাদেশের ক্ষতি
যতটুকু জানা গেছে, রামপালের মালিকানা বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের ৫০ ভাগ করে। মূলধনের ১৫ ভাগ বাংলাদেশের ও ১৫ ভাগ ভারতের। বাকি ৭০ ভাগ আসবে ঋণ থেকে। ঋণ কোথা থেকে আসবে এবং তার সুদ কত তা পরিষ্কার নয়। বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশের পিডিবি। বিদ্যুতের দাম নির্ভর করবে কয়লার দামের উপর। কয়লার দাম নির্ভর করবে প্রাপ্যতা ও পরিবহন খরচের উপর। উৎপাদন খরচ পড়বে অনেক বেশি- সহজেই অনুমেয়। বিভিন্ন অজুহাতে ধাপে ধাপে বিদ্যুতের দাম বাড়বে। বিদ্যুতের দাম যত বাড়বে ভারতের লাভ তত বেশি। টাকা আসবে বাংলাদেশের মানুষের পকেট থেকে। লাভের ৫০ ভাগ পাবে ভারত। সমীকরণ খুব সহজ। ভারত দেবে প্রযুক্তি ও ১৫ ভাগ মুলধন। জমিসহ বাকি সব যাবে বাংলাদেশ থেকে। অথচ ভারতে জায়গা থাকা সত্ত্বেও এ প্রকল্প করতে দেয়া হয়নি। জানা গেছে, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্মসংস্থান হবে মাত্র ৬শ’ মানুষের। অন্যদিকে, সুন্দরবনের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কমপক্ষে ২ লাখ মানুষ নির্ভরশীল।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে সুন্দরবন
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবনের আয়তন অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে ছিল বর্তমান আয়তনের প্রায় দ্বিগুণ। নানান কারণে আয়তন ছোট হয়ে বর্তমানে ঠেকেছে ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারে। যার ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত। ১৯৯৭ সালে সুন্দরবন ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সুতরাং এটি এখন শুধু বাংলাদেশের সম্পদ নয়।ভারতকে খুশি করতে ইতোমধ্যেই সরকার রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করেছে। জাতির কপালে একবার রামপালের স্থান হয়ে গেলে তা সরানো হবে খুব কঠিন। সে টনটনে-বিষফোঁড়া বয়ে বেড়াতে হবে সবাইকে সারাজীবন। মাশুল দিতে হবে গোটা জাতিকে।
পরিবেশবিদ, রাজনৈতিক নেতা ও সুশীলসমাজের সদস্যসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে বাংলাদেশের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে সুন্দরবন ধ্বংসকারী এবং পরিবেশ বিপর্যয়কারী হিসেবে চিহ্নিত রামপাল বিদ্যুৎকন্দ্রের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৩ সালের ২২ অক্টোবর এই বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের কথা থাকলেও প্রধানমন্ত্রী সেই কাজটি সেরেছেন গত ৫ অক্টোবর। তিনি বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্বোধন করেন কুষ্টিয়ায় বসে। এ এক নজিরবিহীন ঘটনা। এই বিদ্যুৎ প্রকল্পটি ভারতের জনগণ তাদের নিজেদের দেশেই করতে দেয়নি। অথচ সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। পরিবেশবিদদের মতে, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুন্দরবন বিরান ভূমিতে পরিণত হবে। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে জীববৈচিত্র্য।
ভারতের স্বার্থের প্রতি দেশের জন্য আত্মঘাতী হলেও তা থেকে পিছপা হচ্ছে না বর্তমান সরকার। গত ৫ বছরে সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপ সেই স্বাক্ষরই বহন করে।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.